কোভিড গার্ল
______________________________________________________
“তারা! তারা!” মায়ের কন্ঠে উদ্বেগ। আমার ঘরের বন্ধ দরজার ঠিক ওপাশে দাঁড়িয়ে নরম গলায় আমাকে ডাকছে মা। বিছানা থেকে নিজেকে টেনে হেঁচড়ে তুলতে তুলতে আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ি। মা চায় না আমি ঘরের দরজা বন্ধ করি কিন্তু আমি জেদ করেই করি। আমাকে দেখে যতখানি দূর্বল মনে হয় আমি যে ততখানি দূর্বল নই হয়ত সেটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করি। সত্য হচ্ছে, বেঁচে থাকাই আমার জন্য একটা যন্ত্রণা। মাঝে মাঝে উঠে দাঁড়াতেও কষ্ট হয়, কয়েক পা হাঁটলেও শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে যায়, অধিকাংশ সময় কথা বলার মতও শক্তি পাই না। আজ আমার ১৫তম জন্মদিন। এতো অল্প বয়েসে আমার এমন ভয়ানক শারীরিক অবস্থা হবার কোন যুক্তি সঙ্গত কারণ নেই। বছর খানেক আগে আমার একবার কোভিড হয়েছিল, মাস ছয়েক ভুগিয়েছিল। কিন্তু আমার দুরাবস্থার শুরু হয় তার পর। স্বাভাবিক জীবনে আমি আর ফিরে যেতে পারি নি। ডাক্তাররা আমার এই ভয়াবহ অবস্থার একটা নাম দিয়েছেন–লং কোভিড। এই জাতীয় কোন কিছুর যে আদৌ অস্তিত্ব আছে কে জানত? মা নিজেই দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দেয়। “মামনি, ঠিক আছিস তো? সেই কখন থেকে ডাকছি তোকে।” মা জানে বিছানা থেকে দরজা পর্যন্ত হেঁটে আসাটাই আমার জন্য একটা সংগ্রামের মত। মা হাসি মুখে বলল, “শুভ জন্মদিন, মামনি!” আমি অস্ফুষ্টভাবে মাকে ধন্যবাদ দেই। “তোর নানা-নানি এসেছে,” মা বলল। “খালা-খালুরাও এসেছে। নতুন ড্রেসটা পরে ফেল। আমার সাহায্য লাগবে? ওটাতে তোকে যা মানাবে না!” বয়েস বারো হবার পর থেকে আমার জন্মদিনের পার্টি হয় নি। আমিই চাই নি। বরং বন্ধুদের সাথে জোট বেঁধে মলে গেছি, জিনিষ পত্র কিনেছি, রেস্টূরেন্টে খেয়েছি। এই বছর তার ব্যতিক্রম হচ্ছে। আমার মন ভালো করবার জন্য মা-ই এই সব সাজ সরঞ্জাম করেছে। আমার বন্ধুদেরকেও নিমন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, আমিই মানা করেছি। চাই না বন্ধুরা আমাকে এই রকম করুণ অবস্থার মধ্যে দেখুক। “আমি নিজেই পারব,” আমি নীচু গলায় বলি। দেশী সালোয়ার-কামিজ পরতে আমার একেবারেই ভালো লাগে না কিন্তু মাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমি তার একমাত্র সন্তান। আমিই তার জীবন। মা নার্স, বাবা ডাক্তার। বছর দুয়েক হল ছাড়াছাড়ি হয়েছে। এখন মায়ের মুক্ত সময়ের প্রায় পুরোটাই যায় আমার পরিচর্যায়। “ঠিক আছে!” মা আশ্বস্ত না হলেও আমার কথা মেনে নেয়। “সাহায্য লাগলে টেক্সট করো।“ চলে যাবার আগে মা দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যায়। ইদানীং গলা চড়িয়ে মাকে যে ডাকব সেই শক্তিও পাই না। সালোয়ার-কামিজ পরতে অনেক্ষণ লাগল। দুটোই হ্লুদ, নক্সা করা। সাথে সাদা লম্বা ওড়না। মা নিজেই পছন্দ করে কিনেছে। মায়ের সব কথা শুনি না কিন্তু আজ আপত্তি করি না। আজকের পার্টির পেছনে অনেক পরিশ্রম করেছে মা। কত কিছু রান্না করেছে, বাসা সাজিয়েছে। ঘরের বাইরে পা রাখতেই নানা-নানীর মুখোমুখি হলাম। তারা আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তারা আমাকে যেমন ভালোবাসেন তেমনি প্রশ্রয় দেন। নানা নীরবে আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন। আমার কখন কি পছন্দ সেটা নিয়ে তাদের পরিষ্কার কোন ধারনা না থাকায় ইদানীং তারা ক্যাশই দেন। আমার যা ভালো লাগে আমি কিনে নিলেই হল। আমি মৃদু হেসে ধন্যবাদ জাতীয় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, নানী বললেন,“তোমাকে কিচ্ছু বলতে হবে না, মামনি। আমরা জানি কথা বলতেও তোমার কষ্ট হয়। আমরা সব সময় তোমার জন্য দোয়া করছি। দেখবে, খুব শীঘ্রই তুমি একদম ভালো হয়ে যাবে।“ আমাকে আগে সবাই ফড়িং বলে ডাকত। সারাক্ষণ ছুটে বেড়াতাম, এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারতাম না। এখন আমার অবস্থা ঠিক তার উল্টো। বুকের গভীর থেকে কান্নার বুদ বুদ উঠে আসছিল, অনেক কষ্টে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করে অপেক্ষমান দুই খালার দিকে ফিরি। লিপি খালা মায়ের বছর দুয়েকের বড়। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, স্বামীর সাথে একই সরকারী সংস্থায় কাজ করেন। তাদের একটি ছেলে, একটি মেয়ে, দু’ জনাই আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়। আজ আসে নি। পারিবারিক পার্টি তাদের পছন্দ না। মা বলে দুটোই বখে গেছে। আমি তাদের দোষ দেই না। আত্মীয় স্বজনরা সারাক্ষণ দোষ ত্রুটি ধরতেই ব্যাস্ত। রীতা খালা মায়ের চেয়ে বছর চারেকের ছোট। তার স্বামী রিয়েল স্টেটে, নিজেকে কোটিপতি বলে জাহির করে বেড়ান। খালার অধিকাংশ সময় কাটে জনসেবামূলক কাজে। তাদের একটিই ছেলে, আট বছরের রনি। পাঁজির পা ঝাড়া হলেও আমার খুব নেওটা। কিন্তু এই মুহুর্তে তার মনযোগ ভিডিও গেমে। ঝট করে আমার দিকে তাকিয়ে কোন রকমে হাত নেড়েই আবার খেলায় ফিরে গেল। ফ্যামিলি রুমে আমার বয়েসী আরেকটা ছেলের সাথে প্লে স্টেশনে খেলছে। ছেলেটাকে দেখে পরিচিত মনে হল না। লিপি খালা আমাকে অনেকক্ষন জড়িয়ে ধরে থাকল। “আমার সবচেয়ে প্রিয় মেয়েটা কেমন আছে আজকে? শুভ ১৫তম জন্মদিন, মামনি। একটা খুব চমৎকার উপহার এনেছি তোমার জন্য। আন্দাজ কর তো কি হতে পারে।“ সে কোন কিছু গোপন রাখতে পারে না। মাকে ইতিমধ্যেই বলে ফেলেছে আমার জন্য খুব দামী একটা হুইল চেয়ার কিনেছে। মা তার এক বান্ধবীর কাছ থেকে পুরানো একটা ধার করে এনেছিল। আমার অবস্থা মাঝে মাঝে এতো সঙ্গিন হয় যে হাঁটতেও পারি না। তখন মা আমাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে বাসার বাইরে ঘোরাতে নিয়ে যায়। কি দুঃস্বপ্নময় পরিস্থিতি! আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি নিজেকে মানিয়ে নিতে। রীতা খালা দাবী করে আমি নাকি দেখতে এবং স্বভাবে হুবহু তার মতই। ভুল। সে ভীষণ আবেগপ্রবণ, একটুতেই ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে লেগে যায়। আমি আবার একেবারেই কাঁদতে পারি না। আমার মানসিক কাঠিন্য দেখে অনেকেই অবাক হয়। রীতা খালা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাও মাও করে কাঁদতে শুরু করল। “আমার সোনামনি! দেখবি আর কয়েক দিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এটা হচ্ছে আল্লাহর পরীক্ষা। আর এই পরীক্ষায় তুই একশ’ তে একশ’ পেয়ে পাশ করছিস।” আমার হাতে চুপিসাড়ে একটা খাম ধরিয়ে দেয়। আরোও ক্যাশ। ঐ খামে কম করে হলেও হাজার খানেক ডলার আছে। আমাকে একটু খুশী করবার জন্য সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করছে। “ধন্যবাদ খালামনি,” আমি ফিসফিসিয়ে বলি। ইতিমধ্যেই ক্লান্তি বোধ করতে শুরু করেছি। রীতা খালা বলল,“বসবি, মামনি?” কলিং বেল বেজে উঠল। ডোরবেল এ্যাপে আগুন্তুককে দেখেই মায়ের মুখ শক্ত হয়ে গেল। “কে?” দুই খালা এক যোগে জানতে চায়। “মালেক,” মা তেঁতো গলায় বলে। আমার বাবা। চৌদ্দ বছরের সুখী বিবাহিত জীবনের পর হঠাৎ ভীমরতি ধরেছিল তার। মাকে ধোঁকা দেয়। ক্ষমা চেয়ে সমস্যা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল কিন্তু মা তাকে ক্ষমা করতে পারে নি। “কি চায়?” নানী বাবাকে কখনই পছন্দ করেন নি। লিপি খালা বলল,”আজ তারার জন্মদিন। হয়ত সে জন্যই এসেছে।” নানা বাবাকে পছন্দ করেন। তিনি বিড়বিড়িয়ে বললেন, “বেচারাকে ঢুকতে দাও। মেয়েটার সাথে দেখা করে যাক।“ নানী কটাক্ষ করতে তিনি দ্রুত সেখান থেকে সটকে পড়লেন। স্ত্রীর কোপানলে পড়তে চান না। মা বিতৃষ্ণ মুখে দরজা খুলতে চলে গেল। রীতা খালা আমাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে একটু। ডাক্তাররা বলেছে কোভিড হবার কারণে আমার লাংগস দূর্বল হয়ে গেছে। আমি বাবার জন্য অপেক্ষা করি। তার চারিত্রিক দোষ ত্রুটি থাকলেও আমার প্রতি তার ভালোবাসা অকৃত্রিম। দুই খালু লিভিংরুমে বসে গল্প করছিলেন। তাদের একজন বাবার জন্য দরজা খুলে দিয়ে থাকবেন। মা দরজা পর্যন্ত যেতে পারল না। মাঝপথেই বাবার মুখোমুখি পড়ে গেল। “তোমাকে কে ঢুকতে দিয়েছে?” মা ক্ষ্যাপা গলায় জানতে চায়। “তারাকে একটু দেখতে এসেছি,” বাবা নিরীহ গলায় বলে। “আজ ওর জন্মদিন।“ “লোকমান ভাই, ওকে ঢুকতে দেয়া আপনার ঠিক হয় নি,” মা রীতা খালার স্বামী লোকমান খালুকে লক্ষ্য করে ধমকে উঠল। “ভুল হয়ে গেছে…” লোকমান খালু কাঁচুমাঁচু মুখ করে বললেন। ক্ষেপে গেলে মায়ের মেজাজের ঠিক থাকে না। সবাই তাকে ভয় পায়। দূর থেকে আমাকে দেখেই বাবা হাত নাড়ল। মা তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে গেল। “গিফট এনেছ? আমার হাতে দিয়ে চলে যাও। আমি ওকে দিয়ে দেব।“ “ওর সাথে আমাকে একটু দেখাও করতে দেবে না?” বাবা করুণ কন্ঠে বলে। “তুমি জানো আমার ভিজিটিং রাইট আছে।“ “জানি।“ মা বাঁকা গলায় বলে। “পাঁচ মিনিট। তারপর ঘাড় ধরে বের করে দেব। তুমি হচ্ছ বদ সঙ্গ।“ বাবার অনেক বদ অভ্যাস ছিল। শুধু যে মাকে ধোঁকা দিয়েছিল তাই নয়, জুয়াও খেলত, মাঝে মাঝে ড্রাগসও নিত। মা বদ অভ্যাসগুলো চোখ বন্ধ করে সহ্য করেছিল কিন্তু যখন হাসপাতালের এক নার্সের সাথে বাবার অবৈধ সম্পর্কের খবর কানে আসে তখন বিচ্ছেদ করা ছাড়া তার আর কোন গত্যন্তর ছিল না। চরিত্রহীণতার সাথে কোন আপোষ নেই। বাবা আমার জন্য বিশাল একটা গোলাপের গোছা এনেছে। আমার প্রিয় ফুল। সাথে একটা ম্যাকবুক প্রো। কয়েক দিন আগে মাকে বলেছিলাম একটা সস্তা ল্যাপটপ কিনে দেবার জন্য। মা নিশ্চয় বাবকে জানিয়েছে। আমি বাবার কাছ থেকে ফুলের গোছাটা নিয়ে নীরবে মাথা নাড়ি। মায়ের সামনে বাবার প্রতি আমি বিশেষ একটা আবেগ দেখাই না। মায়ের মন খারাপ হয়ে যায়। “যাও, এবার ভাগো,” মা বলল। “নাকি একটু কেকও খেতে চাও?” “বেচারা এসেই যখন পড়েছে তখন একেবারে খেয়েই যাক না,” নানা নীচু গলায় বললেন। দুই খালুও বিড় বিড় করে তাদের সমর্থন জানালেন। স্ত্রীদের অগ্নি দৃষ্টির সামনে অবশ্য তারা সকলেই দ্রুত চেপে গেলেন। “অসভ্য ধোঁকাবাজ!” রীতা খালা তীব্র কন্ঠে বলল। “কে জানে কত জনের সাথে সম্পর্ক করেছিল। আমাকেও যে পটানোর চেষ্টা করেছিল, বলেছি তোমাদেরকে?” “তোর মাথা খারাপ হয়েছে?” নানী ধমকে উঠলেন। “বাচ্চাদের সামনে এই কথা তোলার কোন দরকার আছে? চল, ঐ ঘরে চল।“ চার মহিলা বাবাকে একরকম ধাক্কা দিয়ে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। মা আমাকে পাঁচ আঙ্গুল দেখিয়ে গেল, যার অর্থ পাঁচটা মিনিট সময় চাই তার। আমি ফিক করে হেসে ফেলি। চরিত্রের দোষ থাকলেও বাবা এমনিতে মানুষ হিসাবে বেশ সাদা সিধাই নইলে ঐ আগ্নেয়গিরির মধ্যে কেউ জেনেশুনে পা দেয়? নানা এবং খালুরা পরস্পরের দিকে ভীতচকিত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন। আমি নীরবে বসে বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে ছিটকে আসা বাক বিতন্ডার শব্দ শুনি। যে ছেলেটা রনির সাথে প্লে স্টেশন খেলছিল সে একটু দ্বিধা দ্বন্দ্ব করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। বেশ লম্বা, শ্যাম বর্ণ, ভাসা ভাসা চোখ। এবার তাকে আমার খানিকটা পরিচিত মনে হল। “আমাকে চিনতে পারছ না?” ছেলেটা বলে। “আমি রয়। আমরা একই এলিমেন্টারি স্কুলে পড়তাম।“ আরেকটু চেষ্টা করতেই রয়কে আমার মনে পড়ে গেল। এই ছেলেটাই আমাকে দেখলেই বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকত। আমার বান্ধুরা আমাকে ক্ষেপানোর জন্য বলত ও আমার বয় ফ্রেন্ড। তখন ভীষণ চুপচাপ আর লাজুক ছিল। পরে ওর পরিবার অন্য শহরে চলে যায়। সেও অন্য স্কুলে ভর্তি হয়। কি বললে যথপযুক্ত হবে বুঝতে পারি না। সংক্ষেপে বলি, “চিনতে পেরেছি।“ তার মুখখানা হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। “রীতা আন্টির সাথে এসেছি আমি। উনি আমার মায়ের বান্ধবী। ওনার কাছেই শুনলাম তুমি নাকি আর ক্লাশে যাচ্ছ না।” আমি মাথা নাড়ি। “খুব দূর্বল। লং কোভিড।“ “শুনেছি। সবাই তোমাকে কোভিড গার্ল বলে ডাকে। খারাপ অর্থে না।“ আমার অসুখের কাহিনী ছড়িয়ে গেছে। কোভিডের দূর্লভ প্রতিক্রিয়া। অবাক হই না। “রীতা আন্টি বললেন আজ তোমার জন্মদিন,” রয় জ্বল জ্বলে দৃষ্টি নিয়ে বলল। “সেই জন্যেই দেখা করতে এলাম। তোমাকে আমার একটা জিনিষ দেবারও আছে…তোমারই জিনিষ, ফেরত দিতে চাই।“ পকেট থেকে একটা ছোট খাম বের করল সে, আমার হাতে ধরিয়ে দিল। বেশ অবাক হলাম। ভেতর থেকে বের হল আমার পুরানো একটা চুলের লাল ক্লিপ। এলিমেন্টারিতে থাকতে এই জাতীয় ক্লিপ পরতাম। অনেকগুলো ছিল আমার। খামের মধ্যে ক্লিপটার সাথে এক টুকরো কাগজ। তাতে একটা ইমেইল এড্ড্রেস লেখা। আমি নীরবে জানতে চাইলাম, কি এসব? তার মুখ রক্তিম হয়ে উঠল। “তোমার একটা চুলের ক্লিপ। স্কুলের মাঠে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। রেখে দিয়েছিলাম। কাজটা ঠিক হয় নি।“ আমি হাসি ঠেকাতে পারি না। আমার যে এমন একজন গুপ্ত প্রেমিক আছে যে আমার বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া একটা সামান্য ক্লিপ সযত্নে গুছিয়ে রেখেছে সে সম্বন্ধে আমার বিন্দু মাত্র ধারনা ছিল না। আমি কাগজের টুকরোটা বাতাসে নাচাই। একটা মেয়েকে ইমেইল এড্ড্রেস কে দেয়? “যদি কখন নিঃসঙ্গ লাগে আমাকে লিখো,“ সে লাজুক কন্ঠে বলে। তাকে কিছু বলার সুযোগ হয় না আমার। পাশের কামরার দরজা খুলে গেল, সবার আগে বাবা, তার পেছন পেছন চার মহিলা বেরিয়ে আসে। বাবার চোখ মুখ লাল। দু’ একটা চড় থাপ্পড় খেয়ে থাকলে অবাক হবার কিছু নেই। মন্দের ভালো যে বাবাকে ডিনার পর্যন্ত থাকার অনুমতি দেয়া হল । বাবা তাতেই খুশী। সবাইকে দেখে একটু ভড়কে গিয়ে রয় দ্রুত রনির সাথে ভিডিও গেম খেলতে চলে গেল। বাকী সন্ধ্যাটুকু খুব ব্যাস্ততায় কাটল। কিছুক্ষন পর আমার এতো ক্লান্ত লাগতে শুরু করল যে আমি নিজের কামরায় ফিরে গেলাম বিশ্রাম নেবার জন্য। রয়ের সাথে কথা বলার আর সুযোগ হল না। বয়েস যখন কারো ১৫ কৌতূহল দমিয়ে রাখা তার জন্য তখন প্রায় অসম্ভব। বেশ দোনমন করে শেষতক রীতা খালাকে রয়ের কথা জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। তার কাছ থেকে যা শুনলাম তাতে আমার স্তম্ভিত হবার পালা। বছর খানেক আগে রয়ের বাবা-মা দুজনাই হঠাৎ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সে এবং তার দুই ছোট ভাইবোন এক ফুফুর কাছে থাকছিল। সেই ফুফু খালার বান্ধবী। তার নিজের দুটি বাচ্চা আছে। রয়দের তিন ভাইবোনের দেখভাল এবং খরচ বহন করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠছিল। সেই জন্য রয় চলে গেছে ভারতে তার দাদুর কাছে থাকতে। সেখানেই সে হাইস্কুলে যাবে। এবার বুঝলাম আমার সাথে দেখা করতে আসা এবং আমাকে ইমেইল এড্ড্রেস দেবার পেছনে তার কি কারণ ছিল। নিজের এই বেগতিক অবস্থা দেখে নিজের প্রতি আমার এতদিন ভয়ানক করুণা হচ্ছিল। রয়ের পরিস্থিতির কথা শুনে খানিকটা হলেও নিজের মনযোগ অন্যদিকে ফেরানোর একটা সুযোগ পেলাম। ওকে ছোট্ট একটা ইমেইল পাঠালাম। তোমার বাবা-মায়ের কথা আমাকে কেন বল নি? রয়ের উত্তর এলো ঝট করেই। কোভিড গার্ল! বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি সত্যিই আমাকে ইমেইল করেছ! |