অনুবাদ
___________________________________________________
সিংহের খোলস
অনুবাদঃ শুজা রশীদ
এই লেখাটি এখনও বই আকারে প্রকাশিত হয় নি কিন্তু স্থানীয় একটি মাসিক ম্যাগাজিনে পর্ব আকারে মুদ্রিত হচ্ছে। উল্লেখ্য যে আমার সমস্ত বাংলা লেখা ছদ্মনাম শুজা রশীদ ব্যাবহার করে লেখা।
মুখবন্ধ
‘In the Skin of a Lion’ নামটি নেয়া হয়েছে Epic of Gilgamesh নামে একটি মহাকাব্য থেকে। এই মহাকাব্যটি লেখা হয়েছিল সুমেরিয়ান ভাষায় প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় ২১০০ BC তে এবং এটি বিশ্ব সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন মহাকাব্য বলে পরিগণিত হয়। এই মহাকাব্যের কাহিনী উরুকের রাজা গিলগামেশ (আংশিক দেবতা) এবং এনকিদুকে নিয়ে যাকে দেবতারা একজন বন্য মানুষ হিসাবে সৃষ্টি করেছিল স্বৈরাচারী গিলগামেশকে নিরস্ত করবার জন্য। কিন্তু পরবর্তিতে গিলগামেশ এবং এনকিদু পরস্পরের বন্ধুতে পরিণত হয়। যৌথভাবে তারা এমন কিছু কর্মকান্ড করে যা দেবতাদেরকে ক্ষুব্ধ করে এবং ফলস্বরুপ তারা মানব এনকিদুকে মৃত্যুদ্বন্ড দেয়। এনকিদু যখন শোকে দুঃখে বিলাপ করছে তখন জনৈক দেবতা তাকে উদ্দশ্য করে বলে যে তার মৃত্যুর পর জনগণ তার জন্য শোক করবে এবং এমনকি ক্ষমতাশালী গিলগামেশ পর্যন্ত শোকে মুহ্যমান হয়ে তার মাথার চুল কাটা বন্ধ করে দেবে এবং এনকিদুর মত শরীরে “সিংহের চামড়া” পরে মনের দুঃখে পথে পথে ঘুরে বেড়াবে। মাইকেল ওনদাটজি, শ্রীলংকায় জন্মগ্রহণকারী প্রখ্যাত কানাডিয়ান কবি এবং ঔপন্যাসিক, এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন ১৯৮৭ সালে। এই গল্পটি তিনি লিখেছিলেন ১৯০০ সালের প্রারম্ভে টরন্টো শহরের উন্নয়নে বিশাল অবিভাসী কর্মীবাহিণীর নিরলস ভুমিকা নিয়ে যারা অধিকাংশ সময়েই তাদের শ্রমের যথাযথ মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তার এই উপন্যাসে মাইকেল ওন্দাটজি Epic of Gilgamesh এর কাহিনীর কাঠামো আংশিকভাবে অনুসরণ করেছেন টরন্টোর সেই সব অবহেলিত শ্রমিকদের এবং ক্ষমতাশালী এক সিটি কমিশনারের কাহিনী বলতে গিয়ে। মাইকেল ওন্দাটজির ‘In the Skin of Lion’ কে কোন মাপকাঠিতেই গতানুগতিক ইংরাজী উপন্যাস হিসাবে চিহ্নিত করা যাবে না। এর লেখার স্টাইল, কাহিনীর বিন্যাস, চরিত্রের সংগঠন জটিল, কিঞ্চিৎ বিক্ষিপ্ত, কিন্তু পরিশ্রমী, ভাগ্যান্বেষী সাধারণ মানুষেরা যারা পৃথিবীর নানা দেশ থেকে কানাডাতে এসেছিল, যারা শুধু যে একটি বৈরী পরিবেশের সাথেই যুঁঝেছে তাই নয়, একই সাথে ভাষাগত, জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে, তাদের প্রতি লেখকের যে অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে তা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রস্ফুটিত। আমাদের সভ্যতায় সাধারণ মানুষের ভূমিকাকে তুলে ধরবার লেখকের এই আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগ ব্যাক্তিগতভাবে আমাকে নাড়া দিয়েছে। ইতিহাসের পাতা খুলে আমরা রাজা-বাদশাহ, ধনবান, খ্যাতিমান মানুষদের কথা পড়ে মুগ্ধ হই, কখন রোমাঞ্চিত হই, কখন গর্বিত হই, কিন্তু প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তাদের খ্যাতি এবং সাফল্যের পেছনে থাকে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রাণান্তকর অবদান যা অধিকাংশ সময়েই লোক চক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। মাইকেল ওন্দাটজি তার এই গল্পে সেই সব মানুষদের কথাই বলেছেন। তবে তিনি তার গল্পের পরিসর শুধুমাত্র টরন্টো শহরেই নিবদ্ধ রেখেছেন। ফলে পাঠকদের মাঝে যাদের এই শহর এবং তার অতীত সম্বন্ধে জ্ঞান অতিমাত্রায় সীমিত তাদের হয়ত কিছু কিছু স্থানে দূর্বোধ্য মনে হতে পারে। কিন্তু সেই সাময়িক এবং ক্ষণস্থায়ী স্থানগুলো অতিক্রম করতে পারলে পাঠক পুরষ্কৃত হবেন, হয়ত বিহবলিতও হবেন। অনুবাদকের কাজ দুরূহ, বিশেষ করে এমন একটি বইয়ের যার লিখবার ধরণ, কাহিণীর বিন্যাস, ভাষাগত ব্যাবহার – সব কিছু এক ভিন্ন মানের, ভিন্ন মাত্রার। চেষ্টা করেছি কাহিনীর বঙ্গানুবাদের সাথে সাথে লেখকের বর্ণনা, সংলাপের মৌলিকত্ব যতটুকু সম্ভব বজায় রাখতে, যদিও সেটা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজী ভাষায় একটি বাক্য যেভাবে চমৎকার শোনায়, বাংলায় সেটিকে খানিকটা বাংগালীর মত করে না প্রকাশ করলে পাঠকের কাছে কৃত্রিম মনে হবার আশংকা থেকে যায়। প্রচুর পরিশ্রম এবং প্রচেষ্টার ফসল এই অনুবাদ। দক্ষিণ পূর্ব কানাডার একটি ভয়াবহ হাঁড় জমানো শীতকাল এবং একটি অসম্ভব রকমের উজ্জ্বল, উচ্ছল, বর্ণময় গ্রীষ্মকালের মাঝে হাজারো কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই প্রখ্যাত উপান্যাসটিকে রুপান্তরিত করেছি আমার প্রিয় ভাষায়, আমার মায়ের ভাষায়। যদি পাঠকরা লেখাটি পড়ে আনন্দ পান তাহলে আমার শ্রম সার্থক হবে। শুজা রশীদ এজাক্স , কানাডা |